শিখি বাংলায় হলো একটি শিক্ষামূলক ব্লগ যা রচনা, ভাবসম্প্রসারণ, সারাংশ, সারমর্ম ও নানা শিক্ষা ও তথ্যের বিশাল সমাহার

10 April, 2019

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস / একুশের চেতনা ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস / একুশে ফেব্রুয়ারি ও বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস / জাতীয় জীবনে একুশের চেতনা / আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য 


সূচনা
"আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি 
আমি কি ভুলিতে পারি।" 
একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির জীবনে এক গৌরবময় ও ঐঐতিহ্যবাহী দিন। বাঙালির জাতীয় জীবনের সকল চেতনার উৎস হচ্ছে এ দিনটি। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্টা করার ঐতিহাসিক দিন এটি। এদিনেই বাঙালির তাজা রক্ত রাজপথে ঝরেছিল। বাঙালির রক্তঝরা এ দিনটিকে সারা বিশ্বে স্মরণীয় করে রাখতে ইউনেস্কো 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, সম্মান জানিয়েছে ভাষা শহীদদের প্রতি। 

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
 আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

ভাষা আন্দোলনের আদি কথা : পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পূর্বে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড: জিয়াউদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্টভাষা করার প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। পূর্ব বঙ্গ থেকে ড: মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এ প্রস্তাবের ঘোর বিরোধিতা করেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন  করেন (১১ শ্রাবণ, ১৩৫৪ বঙ্গাব্দ)।  এভাবে পাকিস্তান জন্মের আগেই ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে।

বাংলা ভাষার প্রতি অবজ্ঞা ও অবহেলা : এ দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকেই উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার হীন চক্রান্ত চলতে থাকে। ১৯৪৮ সালে রেসকোর্স উদ্যানে মোহাম্মদ আলী জীন্নাহ ঘোষণা করেন, 'উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা '।  এর কিছু দিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তার ঘোষণার পুনরাবৃত্তি করলে তুমুল প্রতিবাদ ধ্বনি উচ্চারিত হয়। 

ভাষা আন্দোলন : মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ১৯৪৮ সালের ঘোষণার পর থেকেই বাংলা ভাষার আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। পশ্চিম পাকিস্তানি ডিক্টেটরগণ যতই বাংলা ভাষার বিরোধিতা করতে থাকে,বাংলা ভাষার আন্দোলন ততই জোরদার হয়। প্রাথমিকভাবে ছাত্ররা এ আন্দোলন চালিয়ে নিলেও পরবর্তীতে গোটা দেশবাসী ছাত্রদের সাথে একাত্ম ঘোষণা করে।দেশবাসীর জোরালো সমর্থনে ছাত্রদের মনোবল আরো বেড়ে যায়, তারা দ্বিগুণ উৎসাহে সম্মুখপানে এগুতে থাকে। 

একুশের স্মৃতি : '৫২র ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনকে সামনে রেখে সমগ্র দেশে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে আন্দোলন জোরদার করা হয়। পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসক ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে সকল প্রকার মিটিং মিছিল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানে প্রত্যয়ী ছাত্র সমাজ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করে। সাথে সাথে পুলিশ মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে সালাম, বরকত, রফিক ও জব্বার সহ আরো অনেকে নিহত হয়। এ হত্যাযজ্ঞ ও দমননীতির ফলে আন্দোলন আরো বেগবান হয়। 

রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি : ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে সংঘটিত মার্মান্তিক হত্যাযজ্ঞের খবর সারা দেশে বিদ্যুৎবেগে পৌছে যায় এবং দেশবাসী প্রচন্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।অত:পর পাকিস্তান সরকার বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দানে বাধ্য হয়। ১৯৫৬ সালে সংবিধানে সরকার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বীকৃতি দেয়। 

আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃতি : একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আর শুধু আমাদের মাতৃভাষা দিবস নয়। প্রতি বছর 'একুশে ফেব্রুয়ারি ' সারা বিশ্বে পালিত হয় 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ' হিসেবে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেস্কো)  -এর সাধারণ পরিষদের ৩০ তম পূর্নাঙ্গ অধিবেশনে বাংলাদেশ সহ ২৭ টি দেশের সমর্থন নিয়ে সর্বসম্মতভাবে 'একুশে ফেব্রুয়ারি ' কে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ' হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ইউনেস্কোর প্রস্তাবে বলা হয়, "১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার জন্য বাংলাদেশের অনন্য ত্যাগের স্বীকৃতি স্বরূপ এবং ১৯৫২ সালের এই দিনের শহীদদের স্মৃতিকে সারা বিশ্বে স্মরণীয় করে রাখতে একুশে ফেব্রুয়ারি কে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ' হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি ইউনেস্কোর ১৮৮ টি সদস্য দেশ এবং ইউনেস্কোর সদর দপ্তর এ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপিত হবে।" ইউনেস্কোর এ ঘোষণার মধ্যে দিয়ে বিশ্বে প্রায় ৫ হাজার ভাষা সম্মানিত হল এবং একবিংশ শতাব্দীর তথা দুই সহস্রাব্দের প্রথম অর্থাৎ ২০০০ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি সারা বিশ্ব ব্যাপী প্রথম পালিত হয় ' আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস '। 

স্বাধিকার চেতনা : ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতির মধ্যে যে চেতনার উন্মেষ হয়, তার চরম বিস্ফোরণ ঘটে উনসত্তর থেকে একাত্তরে। একুশে ফেব্রুয়ারির তাৎপর্য শহীদ দিবস পালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি ; তা বাঙালির জাতীয় জীবনের সর্বত্র প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশের সমস্ত আআন্দোলনের মূল চেতনা একুশে ফেব্রুয়ারি। একুশ থেকেই বাঙলি উপলব্ধি করেছিল তার বাঙালি জাতীয়তাবোধ, তার সংস্কৃতির অতন্দ্র প্রহরী  এই সংগ্রামী চেতনাই বাংলার সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং রাজনৈতিক আন্দোলন এ দুই ধারাকে একসূত্রে গ্রথিত করে মুক্তি সংগ্রামের মোহনায় এনে দিয়েছে। আর এর প্রেক্ষিতেই ১৯৭১ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছে। 

উপসংহার : বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত একুশে ফেব্রুয়ারি 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ' হিসেবে গৃহীত হওয়ার ব্যাপারটি আমাদের তথা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গৌরবের। কারণ, একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে বাঙালি জাতি আত্মমর্যাদার চেতনা লাভ করেছিল ; লাভ করেছিল মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের প্রেরণা এবং অনুভব করেছিল ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা।

No comments:

Post a Comment

বাংলা নববর্ষ / পহেলা বৈশাখ

বাংলা নববর্ষ / পহেলা বৈশাখ  বাংলা নববর্ষ / পহেলা বৈশাখ ভুমিকা : আদিকাল থেকে যেকোন বছরের প্রথম দিনটি 'নববর্ষ' নামে পরিচিত...