শিখি বাংলায় হলো একটি শিক্ষামূলক ব্লগ যা রচনা, ভাবসম্প্রসারণ, সারাংশ, সারমর্ম ও নানা শিক্ষা ও তথ্যের বিশাল সমাহার

11 April, 2019

বাংলা নববর্ষ / পহেলা বৈশাখ

বাংলা নববর্ষ / পহেলা বৈশাখ 
বাংলা নববর্ষ / পহেলা বৈশাখ
বাংলা নববর্ষ / পহেলা বৈশাখ


ভুমিকা : আদিকাল থেকে যেকোন বছরের প্রথম দিনটি 'নববর্ষ' নামে পরিচিত হয়ে আসছে৷ পৃথিবীর সর্বত্রই নববর্ষ একটি প্রচলিত সংস্কৃতি ধারা। পহেলা বৈশাখ বাংলা সনের প্রথম দিন৷ চৈত্র মাসের শেষ দিনের সূর্যাস্তের পর রাতের শেষে নতুন সূর্য উদয়ের মধ্যে দিয়ে নতুন বছরের শুরু হয়। পুরাতন সমস্ত গ্লানি মুছে দিয়ে, পাওয়া না পাওয়ার হিসাব চুকিয়ে প্রতিবছর নতুন পসরা সাজিয়ে আগমন ঘটে নতুন বছরের । একটি বছরের হিসাব নিকাশ শেষ হলেই আরেকটি নতুন বছর শুরু হয়। বাংলা নববর্ষ বাঙালি জাতীর প্রাণে এক আনন্দধারা বইয়ে দেয়। নববর্ষের আগমনে দেশের সর্বত্রই বিরাজ করে এক উৎসব মুখর পরিবেশ। বাংলা নববর্ষ এখন জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বজনীন এক জাতীয় উৎসব এ পরিনত হয়েছে৷ 

নববর্ষের পরিচয় : সৃষ্টির সুচনাকাল থেকেই পৃথিবী আহ্নিক গতি ও বার্ষিক গতির ছন্দে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে ছুটে চলেছে৷ আবার সূর্য তার গ্রহ উপগ্রহ নিয়ে এক মহাপরিক্রমায় ধাবমান। মানুষ তার বুদ্ধিমত্তা নিয়ে এই অনন্ত, অখন্ড মহাকালকে খন্ডিত করে চিহ্নিত করেছে সেকেন্ড-মিনিট-ঘন্টা-দিন-মাস-বছর। মিশরীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বিশ্বের প্রথম পঞ্জিকা সৃষ্টি করেন৷ প্রকৃতির স্বভাব লক্ষনই ছিল মানুষের বর্ষ গণনার উৎস। এই বর্ষ গণনার মধ্যে দিয়েই নববর্ষের সৃষ্টি হয়। 

নববর্ষের ইতিহাস : বাঙালি জাতির জন্ম ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস থেকে জানা যায়,এই গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ এলাকার সভ্যতা, সংস্কৃতি, লোকাচার, উৎসব ও পার্বণ সবই কৃষিকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। বাংলা সনের ক্ষেত্রেও এর ব্যাতিক্রম হয়নি। 
বহু প্রাচীনকাল থেকে আমাদের দেশে নবান্ন উৎসব চালু রয়েছে৷ এ উৎসবের সাথে জড়িয়ে আছে বাংলা সনের জন্মকথা। মোগল সম্রাট আকবর রাজকার্য সম্পাদনে হিজরি সাল নিয়ে অসুবিধার সম্মুখীন হলে তিনি বাংলা সন সৃষ্টির নির্দেশ দেন। এই সন প্রবর্তন করা হয় কৃষকদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের সুবিধার দিকে লক্ষ্য রেখে৷ তখন অগ্রহায়ণ মাসকে বাংলা সনের প্রথম মাস হিসেবে গণনা করা হতো। প্রচলিত হিজরি চান্দ্র সন ও বাংলা সৌর সনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সম্রাটের অর্থমন্ত্রী টোডরমলের নির্দেশনায় রাজজ্যোতিষী মাহাপন্ডিত আমীর ফতেহ উল্লাহ সিরাজী বাংলা সনের উদ্ভাবন করেন ১৫৮৫ সালের ১০ মার্চ। এরপর বহু পণ্ডিত ও গবেষকের মেধা- শ্রম ও প্রাজ্ঞ জ্ঞানের সমন্বয়ে বাংলা সন বর্তমান রূপ লাভ করেছে। ১৯৬৮ সালে মনীষী ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এর নেতৃত্বে বাংলা সনের সংস্কার করা হয়। 

নববর্ষের গুরুত্ব : বাংলা সন শুরু হওয়া বাঙালির জীবনে একটি অসাধারণ ঘটনা। পহেলা বৈশাখ বছরের প্রথম দিন হওয়াটাও তেমনি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বাঙালির কর্মপ্রবাহে বাংলা নববর্ষের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। বাঙালির জীবন যাত্রা, উৎসব অনুষ্ঠান, পালা-পার্বণ, হালখাতা, বিভিন্ন কর্ম সম্পাদন, খাজনা দেওয়া, দৈনন্দিন কাজকর্ম বাংলা সনের দিন তারিখ তিথি নক্ষত্র অনুসারে করা হয়। দৈনন্দিন কাজকর্মে খ্রিষ্টীয় সাল যতই ব্যাবহার করি না কেন  বাংলা সনের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই। এই কারণে আমরা ভুলে যাইনি পহেলা বৈশাখ, ২৫ এ বৈশাখ, ১১ ই জৈষ্ঠ্য ও ২২ এ শ্রাবণ। এছাড়া বাংলা নববর্ষ আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনার শিক্ষা দেয়। 

বর্ষবরণ : বাঙালির জীবনে বাংলা সনের গুরুত্ব অপরিসীম। বাঙালি আজ কেবল গ্রামে -গঞ্জে নয়, শহরে -বন্দরে, রাজধানীতে নববর্ষ নিয়ে সসাংস্কৃতিক অনুষ্টানে মেতে ওঠে। বাংলা একাডেমিকে কেন্দ্র করে আশেপাশের জায়গাগুলোতে বৈশাখী মেলা বসে, চারুকলা ইন্সটিটিউটের ছাত্র ছাত্রীরা লোকজ চিত্রকলা এঁকে, লোকজ সাজে, হাতি, ঘোড়ার মুখোশ তৈরি করে, নানান সাজে, নানাভাবে বৈশাখী শোভাযাত্রা বের করে বাংলা সনকে বরণ করে নিতে। নববর্ষ বরণ করতে ভোর থেকে রবীন্দ্রসংগীতের মনোমুগ্ধকর গান নিয়ে রমনার বটমূলে সমবেত হয় 'ছায়ানট'। পহেলা বৈশাখের সকালে রমনার আশেপাশে ধ্বনিত হয় কবিগুরুর মর্মস্পর্শী বানী -' এসো এসো, এসো হে বৈশাখ '।  সারা দেশেই নববর্ষ কে বরণ করার বিভিন্ন প্রস্তুতি নিতে দেখা যায়। 

শহর ও গ্রামে নববর্ষ উদযাপন :  নববর্ষে পল্লি অঞ্চলের কোথাও কোথাও বর্ণাঢ্য মেলা বসে৷ মেলায় বিচিত্র আনন্দ অনুষ্টান, কেনাবেচার সাথে সাথে মানুষের মিলনের অমলিন খুশি, অবারিত প্রীতি স্পর্শে নববর্ষের বিশেষ দিনটি মুখর হয়ে ওঠে। এছাড়া দরিদ্র ভোজন, নৃত্য -গীত, সভা ও আনন্দ উৎসবে বছরের প্রথম দিনটি মুখরিত হয়।  পল্লির কোথাও কোথাও রচিত হয় নববর্ষ উদযাপন উৎসব -মঞ্চ, যেখানে অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। 
শহরাঞ্চলে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে বের হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও অভিবাদন, শোভাযাত্রা, খেলাধুলায় নববর্ষের সূচনা হয়৷ 

নববর্ষ উদযাপনের বৈশিষ্ট্য : পহেলা বৈশাখে বাংলার মানুষ অতীতের সুখ- দুঃখ ভুলে গিয়ে নতুনের আহ্বানে সাড়া দেয়। প্রত্যহিক কাজকর্ম ছেড়ে ঘরবাড়ি ধুয়েমুছে পরিস্কার করে৷ আটপৌরে জামাকাপড় ছেড়ে নতুন পোশাক পরে৷ বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন দের সাথে দেখা করে এবং পানাহারে মেতে ওঠে৷ 
বাংলা নববর্ষের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো বৈশাখী মেলা। সারা দেশে এ মেলা বসে। মেলায় মূলত মৃৎ ও কুটির শিল্পজাত পণ্যাদির কেনাবেচা হয়। এ মেলা এক দিন থেকে শুরু করে সপ্তাহব্যাপী চলতে থাকে। এটি বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসেবে প্রচলিত। 
বাংলা নববর্ষ কেবল সংস্কৃতির অংশ নয়, এর সাথে অর্থনীতি ও জড়িত। পহেলা বৈশাখ  ব্যবসায়ী মহলের হালখাতার দিন। বিগত বছরের বকেয়া টাকা এই সময় ক্রেতারা পরিশোধ করে থাকেন৷ 
নববর্ষ উপলক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল ও রেডিও বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রচার করে থাকে৷ এছাড়া পত্রিকাগুলোতে নববর্ষ নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন ছাপা হয়। 

উপসংহার : বাংলা নববর্ষ আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের স্বাক্ষর বহন করে৷ রাজনৈতিক আন্দোলন তাতে যুক্ত করেছে নতুন মাত্রা। এর সূচনা ষাটের দশকে। আইয়ুব আমলে রবীন্দ্রসংগীত ও বাঙালি সংস্কৃতির উপর আক্রমণ শুরু হলে সংগীত প্রতিষ্ঠান 'ছায়ানট' পহেলা বৈশাখে নববর্ষ পালনের জন্য রমনার বটমূলে আয়োজন করে রবীন্দ্র সংগীতের। সেই ধারা 'ছায়ানট ' আজও অব্যাহত রেখেছে। বাংলা নববর্ষের এটি একটি উল্লেখযোগ্য দিক৷ নববর্ষ আজ সত্যের গৌরবে,মঙ্গলের গৌরবে, মহত্বের গৌরবে সকলের জীবনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠুক -সেই প্রত্যাশা সকলের। বাংলা নববর্ষ হোক বাঙালির অনন্ত গৌরব৷

No comments:

Post a Comment

বাংলা নববর্ষ / পহেলা বৈশাখ

বাংলা নববর্ষ / পহেলা বৈশাখ  বাংলা নববর্ষ / পহেলা বৈশাখ ভুমিকা : আদিকাল থেকে যেকোন বছরের প্রথম দিনটি 'নববর্ষ' নামে পরিচিত...